ভারত, মিয়ানমার আর থাইল্যান্ডের মধ্যে যে ত্রিদেশীয় হাইওয়ে তৈরির কাজ চলছে, তাতে বাংলাদেশকেও সংযুক্ত করার জন্য সক্রিয় চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। দিল্লিতে গত শুক্রবার (১৪ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে ‘বর্ডার কানেক্টিভিটি’ বা সীমান্ত সংযোগ কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, তা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করতেই দিল্লিতে সেদিন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ল্যান্ড পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ভারতের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ)।
ওই অনুষ্ঠানের অবকাশে সংস্থার চেয়ারম্যান আদিত্য মিশ্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আন্তর্জাতিক ওই হাইওয়ের অংশ হিসেবে সীমান্তবর্তী শহর মণিপুরের মোরেহতে তারা যে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) গড়ে তুলছেন, সেই স্থলবন্দর পরিপূর্ণতা পাবে যদি ওই পথে বাংলাদেশেও পণ্যের আমদানি-রফতানি হতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব প্রভাত কুমারও সেখানে জানান, ওই হাইওয়ের মিয়ানমার অংশে ভারত যে প্রকল্পগুলো সম্পাদন করছে, তার ৫০ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ। এই প্রকল্পগুলো হলো, ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ কালেওয়া-ইয়াগয়ি রোডকে আন্তর্জাতিক হাইওয়ের স্তরে উন্নীত করা এবং তামু-কালেওয়া রোডে ৬৯টি ব্রিজ আর সংলগ্ন অ্যাপ্রোচ রোড পুনর্নির্মাণ।
এই হাইওয়ের সঙ্গে এখন বাংলাদেশও যুক্ত হলে তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অনন্য বাণিজ্যিক সংযোগের কাজ করবে বলেও মন্তব্য করেন ওই সিনিয়র কর্মকর্তা।
মণিপুর-মিয়ানমার সীমান্তের মোরেহ থেকে থাইল্যান্ডের মা সট পর্যন্ত ১৩৬০ কিলোমিটার লম্বা এই আন্তর্জাতিক হাইওয়ের প্রথম প্রস্তাবনা করা হয়েছিল ২০০২ সালে। তখন ঢাকায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। ফলে বাংলাদেশও সেই হাইওয়ে প্রকল্পে যোগ দেওয়ার কোনও আগ্রহ দেখায়নি। এই প্রকল্পে বাংলাদেশ যুক্ত হলে তা হবে ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার শামিল, তখন সরকারের মধ্যে এই ভাবনাও কাজ করেছিল।
দিল্লির এই অনুষ্ঠানেই সীমান্ত-সংযোগ নিয়ে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে ভারতের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ
২০২০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ওই বছরের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ভার্চুয়াল সামিটের শেষে প্রেস বিবৃতিতে জানানো হয়, ত্রিদেশীয় হাইওয়েতে যুক্ত হতে চেয়ে বাংলাদেশ ভারতের সমর্থন চেয়েছে। তিন মাস পর নরেন্দ্র মোদি যখন ঢাকা সফর করেন, তখনও দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনায় বিষয়টি উঠে আসে।
এরপর থেকে সেই লক্ষ্যে অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে। মাস চারেক আগে ঢাকায় থাই পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও জানিয়েছিলেন, ত্রিদেশীয় হাইওয়েতে চতুর্থ দেশ হিসেবে তাদের যোগদানে ভারত ও থাইল্যান্ড পুরোপুরি রাজি– শুধু মিয়ানমারই এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান এখনও স্পষ্ট করেনি।
দিল্লিতে শীর্ষ সরকারি সূত্রগুলো বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, মিয়ানমারকে এ ব্যাপারে রাজি করানোর জন্যই ভারত পর্দার আড়ালে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, ভারতও মনে করে ভৌগোলিক, বাণিজ্যিক বা কৌশলগত দিক থেকে এই হাইওয়ে প্রকল্প তখনই পরিপূর্ণতা পাবে যখন এই অঞ্চলের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশকেও তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
প্রথম পর্যায়ে ত্রিদেশীয় হাইওয়ে যে রুট ধরে যাবে
বাংলাদেশের দিক থেকে এই প্রকল্পে যোগদানে আগ্রহের কারণ মূলত দুটো। সেগুলো হলো–
(ক) আসিয়ানের প্রবেশপথ: এই হাইওয়ে চালু হলে বাংলাদেশের জন্য তা সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা আসিয়ানের দরজাকে উন্মুক্ত করে দেবে। আপাতত থাইল্যান্ডে শেষ করার কথা থাকলেও প্রকল্পের অংশীদার তিনটি দেশই চায় শেষ পর্যন্ত এই হাইওয়েকে কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত করতে। সেক্ষেত্রে এই হাইওয়ে হয়ে উঠবে আসিয়ান ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রকৃত সেতুবন্ধ। ঢাকা বা কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে শুধু ব্যাংকক নয়, হো চি মিন সিটি পর্যন্ত চলে যাওয়া যাবে।
(খ) ভুটান-নেপালে অ্যাকসেস: বাংলাদেশ চায় এই হাইওয়ে শুধু তাদের দক্ষিণ-পূর্বে নয়, পশ্চিম দিকেও প্রসারিত হোক। অর্থাৎ, এই হাইওয়ে বরাবর একদিকে যেমন মিয়ানমার-থাইল্যান্ডে যাওয়া যাবে, তেমনি উল্টোদিকে যাতে ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটানেও বাংলাদেশের ট্রাক যেতে পারে, ঢাকা সেই বিষয়টির ওপরও বিশেষ জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপালের মধ্যে ইতোমধ্যে যে বিবিআইএন মোটর ভেহিকেল চুক্তি আছে, সেটাও এক্ষেত্রে খুবই সহায়ক হতে পারে।
আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, এর আগে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার এই চার দেশ মিলে যে ‘বিসিআইএম করিডর’ নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তাতে বিশেষ অগ্রগতি না হওয়ায় এখন এই ত্রিদেশীয় হাইওয়েই সেটির উপযুক্ত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
ভারতের স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের হয়ে যিনি ভারত-মিয়ানমার কানেক্টিভিটি সংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রস্তুত করেছেন, সেই অধ্যাপক প্রবীর দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, এই ত্রিদেশীয় হাইওয়েকে কিন্তু আঞ্চলিক কনটেক্সটে ‘বিমসটেক হাইওয়ে’ নামেও ডাকা হয়। কারণ এটি বিমসটেক কানেক্টিভিটির মাস্টারপ্ল্যানেও আছে। এখন যেহেতু বাংলাদেশ বিমসটেক জোটের পূর্ণ সদস্য, ফলে এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার শতভাগ এখতিয়ার তাদের আছে।
‘বাংলাদেশও মনে করে বিষয়টি ফলাও করে ঘোষণার কিছু নেই, বিমসটেক সদস্য হিসেবে তারা এমনিতেই এই প্রকল্পে আসতে পারে। আমার ধারণা, ধুমধাম করে এই প্রকল্পে যোগ দিতে গেলে তা চীনকে অযথা বিরক্ত করতে পারে, এই ভাবনা থেকেই বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে একটু সাবধানে এগোতে চাইছে। আর ভারতও সেটা মাথায় রেখেই ধীরে ধীরে পা ফেলছে’, বলছিলেন ড. দে।
এখন প্রশ্ন হলো, হাইওয়ে প্রকল্পে বাংলাদেশের যোগদান চূড়ান্ত হলে তারা কোন রুটে এই মহাসড়কে সংযুক্ত হবে?
এখানেও বিশেষজ্ঞরা দুটো সম্ভাব্য রুট ভেবে রেখেছেন। এর একটা হলো, ঢাকা-আগরতলা-শিলচর-ইম্ফল হয়ে মোরেহতে এই হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ। দ্বিতীয়টা হলো, ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে আগরতলা-আইজল হয়ে মিজোরাম-মিয়ানমার সীমান্তের জোখাওথর থেকে মিয়ানমারের চিন স্টেটে টেডিন পর্যন্ত এই হাইওয়ের একটি অতিরিক্ত কানেক্ট তৈরি করা, অর্থাৎ একটি শাখা রুটের মাধ্যমে মূল হাইওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ।
যে পথেই হোক, বাংলাদেশকে যে এই প্রকল্পে চাই-ই চাই, তা নিয়ে আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনও সন্দেহ নেই। শুক্রবার দিল্লির ওই অনুষ্ঠানে এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স থিঙ্কট্যাঙ্কের কর্ণধার সব্যসাচী দত্ত যেমন বলছিলেন, ‘এই প্রকল্পে বাংলাদেশ যে যোগ দিতে চেয়েছে সেটা খুবই ইতিবাচক লক্ষণ। এখন বাকি দেশগুলোর দায়িত্ব তাদের সেই আগ্রহকে স্বার্থক পরিণতি দেওয়া।’
ভারতে ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ইকোনমিক ফান্ডামেন্টালসের অধিকর্তা আফাক হুসেইনও মন্তব্য করেন, ‘এই হাইওয়ে বাণিজ্যিকভাবে পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে সেটার যে সাপ্লাই চেইন, বাংলাদেশ হবে তার অপরিহার্য অংশ। অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের পণ্য এই পথে না-নিয়ে আসতে পারলে এই মহাসড়কের সম্ভাবনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাই যাবে না।
পাঠকের মতামত